মোঃ আবুল কাসেম, রামু ঈদগড়:
রামু উপজেলার ঈদগড়-গর্জনীয়া ইউনিয়ন এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী-দোছড়ি এলাকায় বার বার একই কায়দায় অপহরণ হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অসহায়। এই অঞ্চলে যতসব অপহরণ হয়েছে প্রত্যেক ঘটনা ও মুক্তিপন আদায় একই কায়দায় হচ্ছে। এতে করে অপহৃতের পরিবার হচ্ছে মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, আইনশৃঙ্খলা অবনতির ভার বহন করছে প্রশাসন আর পর পর অপহরণের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হচ্ছে অপহরণকারী চক্রের। যার কারণে চক্রটির কাছে অপহরণ হয়ে উঠেছে একপ্রকার শিল্পের মতো!!

অপহৃত ব্যক্তিরা ফিরে আসার পরও থেমে নেই পুলিশের তৎপরতা। দুই জেলা পুলিশের কর্মকর্তাগণ প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে অপহরণ ঠেকানোর প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৫ জুলাই ও ৬ জুলাই গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বাইশারী পুলিশের আলোচিত উপ পরিদর্শক আবু মুছার নেতৃত্বে অপহরণকারী দলের সদস্য ঈদগাঁও সদর ইসলামাবাদ ইউনিয়নের তারেকুল ইসলাম (১৬) ও গিয়াস উদ্দিন (১৮) সহ দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। তারা জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদেরকে দূর্র্ধষ আনোয়ার বাহিনীর সদস্য বলে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। এর আগেও বান্দরবান জেলা পুলিশের এই আলোচিত অফিসারের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে অপহরণ চক্রের সদস্য গজালিয়ার সেলিম, বড়বিলের নুরুল হাকিম,শফিউল আলম, বাইশারীর আব্দুছালাম এবং গর্জনিয়ার জাহাঙ্গীর ও ইদগড়ের বৈদ্যপাড়ার জসিম ডাকাতদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু এতে করেও অপহরণকারীদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। বাইশারীর পাহাড়ে বসে এই অঞ্চলের শীর্ষ ডাকাত আনোয়ার বিভিন্ন এলাকা হতে সন্ত্রাসীদের এনে ও অস্ত্র যোগাড় করে একটি ভয়ংকর বাহিনী গড়ে তুলেছে। এলাকাবাসীর কাছে তার এই বাহিনী আনাইয়া বাহিনী নামে পরিচিত।

এই প্রসঙ্গে বাইশারী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একাধিক অপহরণ ঘটনায় পাহাড়ে অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া এসআই আবু মুছা এ প্রতিবেদককে বলেন, মিয়ানমার, রামু উপজেলা ও আলীকদম সীমান্তের মধ্যবর্তী বাইশারী-ঈদগড়-দোছড়ি এলাকাগুলো অত্যধিক দুর্গম আর পাহাড় বেষ্টিত। তাই অপহরণের পর অপহরণকারীরা যেখানে সাধারণ মানুষের বিচরণ নেই সেদিকে দ্রুত অপহৃতদের নিয়ে যায়। পাহাড় আর জঙ্গলের কারণে অনেক সময় মোবাইল ট্রেকিংও কাজে আসে না। তবে এই অঞ্চলে অপরাধের সাথে জড়িতদের বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন সজাগ রয়েছে। কয়েকজন দূর্র্ধষ অপহরণকারীকে আটকও করা হয়েছে।

৩০ জুন রবিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রামু উপজেলার গর্জনীয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড দক্ষিণ নজুমাতবর পাড়া গ্রামে ডাকাতিও অপহরণ হয়েছে। অপহরনের শিকার হওয়া দুই সহোদর হলেন- আমির হোসেনের পুত্র শহিদুল্লাহ (১৩) ও মোঃ রিদুয়ান (১৬)।
প্রত্যক্ষদর্শী গৃহকর্তা আমির হোসেন জানান, রবিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ১০/১২ জনের সশস্ত্র ডাকাত দল ঘরের দরজা ভেঙ্গে বাড়ীর লোকজনদের জিম্মি করে ৮টি মোবাইল সেট ও নগদ দেড় লাখ টাকা সহ বিভিন্ন মুল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে চলে যাওয়ার সময় তার দুই ছেলেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে, মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তথ্যনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালে ১০ ডিসেম্বর ঈদগড়-ঈদগাঁও সড়কের পানেরছড়া ঢালা হতে সর্ব প্রথম অপরহণ হয় ঈদগড় ইউনিয়নের মৃত আলকাছ আহম্মদের ছেলে বনি আমিন ও সিকদার পাড়া এলাকার আবুবকর সিকদারের ছেলে আকবর হোসেন, ৭২ ঘন্টা পর ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মুক্তি পান, ২০১৩ হতে ২০১৫ সালে পর্যন্ত প্রায় শতাধিক লোক অপহরণের শিকার হয়, ২২-৪ ২০১৫ সকাল ৮টার সময় ঈদগড় সড়কের হিমছড়ি ঢালাস্থ সাততারা ঘোনা নামক স্থান হতে অপহরণের শিকার হন ঈদগড় বড়বিল এলাকার কাশেম আলীর পুত্র সিএনজি চালক সাইফুল ইসলাম (২২), বাইশারী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার ফরিদুল আলম ও ঈদগড় বড়বিল এলাকার মোঃ হোছনের পুত্র নুরুল ইসলাম। ৪৮ ঘন্টা পর মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।

২০১৬ সালের ২৫ জুন ঈদগাঁও হতে ঈদগড় যাওয়ার পথে কক্সবাজার সদরের হিমছড়ি নামক স্থান হতে অপহরণের শিকার হয় ঈদগড় ছগিরা কাটা এলাকার জালাল আহাম্মদের পুত্র দেলোয়ার হোসেন (২৩),পুর্ব রাজঘাট এলাকার রশিদ আহাম্মদের পুত্র কারী মৌলানা মনিরুল ইসলাম খোকন (৩৩), গিলাতলি এলাকার মোঃকালোদেরকে ৩ দিন পর হলেও মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়, ১১ অক্টোবর ২০১৬ বাইশারী ইউনিয়নের ব্যাঙডেবা এলাকা থেকে মো. ইউনুছ, মো. করিম, মো. আবু বক্করকে অপহরণ করা হয়। পরে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়।

এছাড়াও ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট লম্বাবিল এলাকা থেকে হাফেজ রশিদ উল্লাহ, ২০১৬ সালের ১ মে দোছড়ি ইউনিয়নের ওয়াচ্ছাখালি থেকে বুলবুল আক্তার (১১), ১২ আগস্ট বাইশারী ইউনিয়নের রাঙ্গাঝিরি থেকে মিজানুর রহমান, একই মাসে দোছড়ি ইউনিয়নে লংগদু থেকে ফরিদুল আলম, মো. হুমায়ুন কবির, বড়ইচর এলাকা থেকে জালাল উদ্দিন, আবদুল কাদের, ২৩ অক্টোবর পিএইচপি রাবার বাগানের ৮নং ব্লক থেকে আজিজুল হক, নুরুল আলম, আবদু শুক্কুর, ২০১৬ সালে ২৪ আগস্ট বাইশারী-ঈদগড় ঈদগাঁও সড়কের ধুমছাকাঠা স্থান থেকে মিনি বাস থামিয়ে ডাকাতির পর মৌলানা হাবিবুর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ,বাইশারীর ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দীনকে, ৩০ ঘন্টা পর ৪ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, ৪ ফেব্রুয়ারি বাইশারী ইউনিয়নের লেদুরমুখ থেকে ছালেহ আহামদ ও রাজিব, ৩০ এপ্রিল বাইশারী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি চাইল্যাতলী থেকে মো. শাহজালাল, ৫ মে ঈদগড় বাজার থেকে যাত্রী নিয়ে রাঙ্গাঝিরি যাওয়ার পথে মিজানুর রহমান, ২১ নভেম্বর ঘুমধুম জামতলী পাড়া থেকে মো. হোছন, নুরুল আজিম, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি লেদুখাল এলাকা থেকে আবদুর রহিম, আবু ছৈয়দ, আবদুল আজিজ, শাহ আলম, গত বছরের ২১ নভেম্বর বাকখালী মৌজার ছাগলখাইয়া থেকে নুরুল আজিম, মো: হোছন, ও কাগজিখোলা থেকে ছৈয়দ বাবর (৩০), ঈদগাঁও-ঈদগড় সড়কের কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়ন ও রামু উপজেলা ঈদগড় সড়কের সীমানায় গজালিয়া এলাকায় গত বছরের ২৮ নভেম্বর মঙ্গলবার রাত ১০ টার দিকে ঈদগড় যাওয়ার পথে সি এন জি ও ১টি মোটরসাইকেল ব্যারিকেড দিয়ে ৮-১০ জন সশস্ত্র মুখোশ ধারী সন্ত্রাসী যাত্রীদের কাছ থেকে মারধর করে নগদ ৩০-৪০হাজার টাকা ও মোবাইল কেড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় রামু উপজেলা ঈদগড় ইউনিয়নের বাইতুশরফ এলাকার নুরুল আমিন ও হেলাল উদ্দিন নামের ২জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ৭২ ঘন্টা পর তারা নিজেদের বুদ্ধি মত্তায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
সর্বশেষ গত ১৭ এপ্রিল দোছড়ি ইউপির লংগদুর মুখ থেকে সাইফুল ইসলামসহ অন্তত আরো শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দাকে অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায় করেছে এ সিন্ডিকেটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অপহরণ, জিম্মায় রাখা এবং মুক্তিপণ তিন ধাপে হয়ে থাকে অপহরণ বাণিজ্য। অপহরণকারীরা হস্তান্তর করে জিম্মাদারদের। বাইরে থেকে অপর একটি গ্রুপ মুক্তিপন আদায় করে। যেখানে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত বলে জনশ্রুতি রয়েছে এলাকায়। তবে জিম্মাদাররা সবাই ভাড়াটিয়া। রামুর ইদগডের দায়িত্বপ্রাপ্ত এএসআই মোর্শেদুল আলম জানান,বিগত ১ বছর যাবত আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের মাধ্যমে।

প্রযুক্তি ব্যবহারের পরও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অপহৃতদের উদ্ধারে বার বার ব্যর্থ হওয়ার পেছনে দুর্গম আর পাহাড়ি জঙ্গলই কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মধ্যে যারা অপহরণ করে তারা এই পেশাটিকে শিল্প হিসেবে নিয়েছে। এলাকাবাসী দাবি করেন কক্সবাজার ও বান্দরবান দুই জেলার সমন্নয়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করে হলেও অপহরণ চক্রের পাহাড়ি গড়ফাদার সহ বাহিনী প্রধান শীর্ষ সন্ত্রাসী আনোয়ার সহ তার বাহিনীকে গ্রেফতার করা হোক।
স্থানীয় জনসাধারন মনে করেন আনোয়ার ডাকাত সহ বাহীনির সদস্যদের ধরা গেলেই অপহরণ বাণিজ্য বহুলাংশ কমে যাবে এই অঞ্চলে।